তাওহীদ বনাম শিরক: ইসলামের আলো ও অন্ধকার
ভূমিকা
ইসলাম এক সরল, যৌক্তিক ও পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থার নাম। এর মূলে রয়েছে এক অদ্বিতীয় বিশ্বাস, যা হলো ‘তাওহীদ’ বা আল্লাহর একত্ববাদ। তাওহীদ ইসলামের মূল ভিত্তি, যার ওপর পুরো দ্বীনের কাঠামো দাঁড়িয়ে আছে। এর বিপরীত ধারণাটি হলো ‘শিরক’, যা আল্লাহর সাথে কাউকে অংশীদার স্থাপন করাকে বোঝায়। ইসলামে শিরককে সবচেয়ে বড় গুনাহ ও ভয়াবহ অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। এই প্রবন্ধে আমরা তাওহীদের গুরুত্ব, শিরকের ভয়াবহতা এবং এ থেকে মুক্তির উপায় নিয়ে কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে বিস্তারিত আলোচনা করব।
প্রথম অধ্যায়: তাওহীদের পরিচয়, প্রকারভেদ ও গুরুত্ব
তাওহীদের শাব্দিক ও পারিভাষিক অর্থ
‘তাওহীদ’ (توحيد) একটি আরবি শব্দ, যার মূল অর্থ হলো কোনো কিছুকে এক বানানো বা একক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া। ইসলামী পরিভাষায়, মহান আল্লাহ তা'আলাকে তাঁর সত্তা (ذات), নাম ও গুণাবলি (أسماء وصفات), এবং ইবাদত ও সার্বভৌমত্বে (عبادة وحاكمية) এক ও অদ্বিতীয় হিসেবে বিশ্বাস করা, জানা এবং বাস্তব জীবনে তা মেনে চলার নামই হলো তাওহীদ।
এই বিশ্বাসের মূল ভিত্তি হলো শাহাদার প্রথম অংশ— "লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ" (لا إله إلا الله), যার অর্থ "আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য উপাস্য নেই।"
তাওহীদের প্রকারভেদ
ইসলামী পণ্ডিতগণ তাওহীদকে সঠিকভাবে বোঝার জন্য তিনটি প্রধান ভাগে ভাগ করেছেন:
১. তাওহীদুর রুবুবিয়্যাহ (توحيد الربوبية): প্রতিপালন ও কর্তৃত্বে আল্লাহর একত্ব এর অর্থ হলো—আল্লাহকে একমাত্র সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা, রিজিকদাতা, বিধানদাতা এবং মহাবিশ্বের একচ্ছত্র অধিপতি হিসেবে বিশ্বাস করা। তিনি একাই সবকিছু পরিচালনা করেন; তাঁর হুকুম ছাড়া গাছের একটি পাতাও নড়ে না।
কুরআনের দলিল: আল্লাহ তা'আলা বলেন, "জেনে রেখো, সৃষ্টি করা এবং আদেশ দেওয়া একমাত্র তাঁরই কাজ। বরকতময় আল্লাহ, বিশ্বজগতের প্রতিপালক।" (সূরা আল-আ'রাফ, ৭:৫৪)
আরও বলেন, "সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি বিশ্বজগতের প্রতিপালক।" (সূরা আল-ফাতিহা, ১:২)
এমনকি আরবের কাফিররাও এই তাওহীদকে স্বীকার করত। কিন্তু শুধু এই বিশ্বাস কাউকে মুসলিম বানানোর জন্য যথেষ্ট নয়।
২. তাওহীদুল উলুহিয়্যাহ বা ইবাদাহ (توحيد الألوهية/العبادة): উপাসনায় আল্লাহর একত্ব এটিই হলো তাওহীদের মূল দাবি এবং নবী-রাসূলদের দাওয়াতের প্রধান বিষয়। এর অর্থ—সকল প্রকার ইবাদত, যেমন: দোয়া, নামায, রোজা, কুরবানি, মানত, সিজদাহ, তাওয়াফ, ভয়, আশা ও ভরসা—একমাত্র আল্লাহর জন্যই নিবেদন করা। আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো পীর, অলি, নবী, ফেরেশতা বা মূর্তির কাছে কোনো প্রকার ইবাদত করা যাবে না।
কুরআনের দলিল: আল্লাহ তা'আলা বলেন, "আর আপনার প্রতিপালক আদেশ করেছেন যে, তোমরা তাঁকে ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করবে না।" (সূরা বনী ইসরাঈল, ১৭:২৩)
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন, "বলো, আমার নামায, আমার কুরবানি, আমার জীবন ও আমার মরণ—সবকিছুই বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য।" (সূরা আল-আন'আম, ৬:১৬২)
হাদিসের দলিল: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, "দোয়াই হলো ইবাদত।" (সুনানে তিরমিজি, সহীহ) তাই আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে অলৌকিকভাবে সাহায্য চাওয়া শিরক।
৩. তাওহীদুল আসমা ওয়াস সিফাত (توحيد الأسماء والصفات): নাম ও গুণাবলিতে আল্লাহর একত্ব এর অর্থ হলো—কুরআন ও সহীহ হাদিসে আল্লাহর যে সমস্ত সুন্দর নাম (আল-আসমাউল হুসনা) ও সুউচ্চ গুণাবলির (সিফাত) বর্ণনা এসেছে, সেগুলোকে কোনো ধরনের পরিবর্তন, বিকৃতি (تحريف), অস্বীকার (تعطيل), সাদৃশ্য (تمثيل) বা ধরন নির্ধারণ (تكييف) ছাড়াই বিশ্বাস করা। যেমন: আল্লাহ দেখেন, শোনেন, আরশে সমুন্নত আছেন—কিন্তু তাঁর দেখা, শোনা বা অবস্থান সৃষ্টির মতো নয়।
কুরআনের দলিল: আল্লাহ তা'আলা বলেন, "কোনো কিছুই তাঁর সদৃশ নয়, আর তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা।" (সূরা আশ-শূরা, ৪২:১১)
তাওহীদের গুরুত্ব
তাওহীদ মুমিনের জীবনে প্রশান্তি, আত্মমর্যাদা এবং আল্লাহর ওপর পূর্ণ নির্ভরতা এনে দেয়। এটিই জান্নাত লাভের একমাত্র চাবিকাঠি।
হাদিসের দলিল: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, "যে ব্যক্তি এমন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে যে সে জানে ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য উপাস্য নেই’, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।" (সহীহ মুসলিম)
দ্বিতীয় অধ্যায়: শিরকের পরিচয়, প্রকারভেদ ও ভয়াবহতা
শিরকের শাব্দিক ও পারিভাষিক অর্থ
‘শিরক’ (شرك) শব্দের অর্থ অংশীদারিত্ব, ভাগ বা শরিকানা। ইসলামী পরিভাষায়, আল্লাহর রুবুবিয়্যাত, উলুহিয়্যাত অথবা তাঁর নাম ও গুণাবলির কোনোটিতে অন্য কাউকে অংশীদার বানানোই হলো শিরক। এটি তাওহীদের সম্পূর্ণ বিপরীত এবং ইসলামের দৃষ্টিতে সবচেয়ে বড় অপরাধ।
শিরকের প্রকারভেদ
শিরক প্রধানত দুই প্রকার:
১. শিরকে আকবার (بড় শিরক): এটি এমন শিরক যা ব্যক্তিকে ইসলাম থেকে বের করে দেয়। তাওবা না করে এই শিরকের ওপর মৃত্যুবরণ করলে তার জন্য জান্নাত হারাম এবং সে চিরস্থায়ী জাহান্নামী হবে। তার কোনো ভালো আমল কবুল হবে না।
কুরআনের দলিল: আল্লাহ তা'আলা বলেন, "নিশ্চয় যে আল্লাহর সাথে শরিক করে, তার ওপর আল্লাহ জান্নাত হারাম করে দিয়েছেন এবং তার ঠিকানা জাহান্নাম। আর জালিমদের জন্য কোনো সাহায্যকারী নেই।" (সূরা আল-মায়েদা, ৫:৭২)
আল্লাহ আরও বলেন, "যদি তুমি শিরক করো, তবে তোমার সকল আমল অবশ্যই নিষ্ফল হয়ে যাবে এবং তুমি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে।" (সূরা আয-যুমার, ৩৯:৬৫)
শিরকে আকবারের কিছু উদাহরণ:
আল্লাহ ছাড়া অন্যকে সিজদাহ করা।
মৃত পীর, অলি বা মাজারের কাছে সন্তান, রিজিক বা বিপদ থেকে মুক্তি চাওয়া।
আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নামে পশু যবেহ করা বা মানত করা।
গণক বা জ্যোতিষীর কথায় বিশ্বাস করে ভাগ্য পরিবর্তনের আশা করা।
আল্লাহর আইনকে বাদ দিয়ে মানব রচিত আইনকে श्रेष्ठ মনে করা।
২. শিরকে আসগর (ছোট শিরক): এটি ব্যক্তিকে ইসলাম থেকে বের করে না, তবে এটি কবিরা গুনাহর চেয়েও ভয়াবহ। এর মাধ্যমে ব্যক্তির আমলের সওয়াব নষ্ট হয়ে যায় এবং সে কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হতে পারে।
হাদিসের দলিল: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, "আমি তোমাদের ওপর যে জিনিসটি সবচেয়ে বেশি ভয় করি, তা হলো শিরকে আসগর (ছোট শিরক)।" সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, "হে আল্লাহর রাসূল, ছোট শিরক কী?" তিনি বললেন, "রিয়া (লোক দেখানো ইবাদত)।" (মুসনাদে আহমাদ, সহীহ)
শিরকে আসগরের কিছু উদাহরণ:
রিয়া (الرياء): মানুষকে দেখানোর জন্য বা প্রশংসা পাওয়ার উদ্দেশ্যে ইবাদত করা। যেমন: মানুষ দেখছে বলে নামায সুন্দর করা।
আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছুর নামে শপথ করা। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, "যে ব্যক্তি আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে শপথ করল, সে শিরক করল।" (সুনানে তিরমিজি, সহীহ)
"আল্লাহ এবং আপনি যা চেয়েছেন" (ما شاء الله وشئت) বলা। এর পরিবর্তে বলতে হবে, "আল্লাহ যা চেয়েছেন, অতঃপর আপনি যা চেয়েছেন।"
শিরকের ভয়াবহতা
শিরক হলো আল্লাহর প্রতি সবচেয়ে বড় অবিচার। কারণ, যিনি সৃষ্টি করেছেন, তাঁর সাথে তাঁরই দুর্বল সৃষ্টির তুলনা করা হয়।
কুরআনের দলিল: আল্লাহ তা'আলা বলেন, "নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর সাথে শরিক করাকে ক্ষমা করেন না। এ ছাড়া অন্যান্য অপরাধ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন। আর যে আল্লাহর সাথে শরিক করে, সে এক মহাপাপ রচনা করল।" (সূরা আন-নিসা, ৪:৪৮)
হাদিসের দলিল: আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে জিজ্ঞেস করলাম, "আল্লাহর নিকট সবচেয়ে বড় গুনাহ কোনটি?" তিনি বললেন, "তুমি আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করবে, অথচ তিনিই তোমাকে সৃষ্টি করেছেন।" (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)
তৃতীয় অধ্যায়: মুক্তির শর্ত ও আমাদের করণীয়
শিরকের ভয়াবহ পরিণতি থেকে মুক্তি পাওয়ার একমাত্র পথ হলো মৃত্যুর আগে একনিষ্ঠভাবে তাওবা করে বিশুদ্ধ তাওহীদের দিকে ফিরে আসা।
শিরক থেকে মুক্তির শর্ত
১. তাওবা করা: কৃত শিরকের জন্য অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া এবং ভবিষ্যতে এমন কাজ না করার দৃঢ় সংকল্প করা। ২. বিশুদ্ধ জ্ঞান অর্জন: তাওহীদ ও শিরক সম্পর্কে কুরআন ও সহীহ সুন্নাহ ভিত্তিক সঠিক জ্ঞান অর্জন করা অপরিহার্য। ৩. আমল পরিশুদ্ধ করা: সকল ইবাদত একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করা এবং 'রিয়া' থেকে বেঁচে থাকা। ৪. শিরকের সকল মাধ্যম বর্জন: যে সকল কাজ, স্থান বা বিশ্বাস শিরকের দিকে নিয়ে যায়, তা থেকে দূরে থাকা।
হাদিসের দলিল: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) শিরক থেকে বাঁচার জন্য এই দোয়াটি শিখিয়েছেন: "আল্লাহুম্মা ইন্নী আ'উযুবিকা আন উশরিকা বিকা ওয়া আনা আ'লাম, ওয়া আসতাগফিরুকা লিমা লা আ'লাম।" "হে আল্লাহ! আমি জেনে-শুনে তোমার সাথে শিরক করা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি এবং যা আমি না জেনে করে ফেলি, তার জন্য তোমার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি।" (মুসনাদে আহমাদ, সহীহ)
উপসংহার
তাওহীদ হলো জান্নাতের চাবি এবং শিরক হলো জাহান্নামের পথ। তাওহীদ মানুষকে সৃষ্টির দাসত্ব থেকে মুক্ত করে এক আল্লাহর গোলামিতে এনে সম্মানিত করে, পক্ষান্তরে শিরক মানুষকে সম্মানিত অবস্থান থেকে নামিয়ে সৃষ্টির পূজায় লিপ্ত করে অপমানিত করে। কিয়ামতের দিন কোনো সম্পদ বা সুপারিশ কাজে আসবে না, যদি ঈমানের মধ্যে শিরকের কালিমা লেগে থাকে।
তাই আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব হলো তাওহীদকে সঠিকভাবে জানা, মানা এবং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন করা। পাশাপাশি শিরকের মতো ভয়াবহ পাপ থেকে নিজে বেঁচে থাকা এবং পরিবার ও সমাজকে বাঁচানোর জন্য চেষ্টা করা। আল্লাহ আমাদের সবাইকে বিশুদ্ধ তাওহীদের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকার এবং শিরকমুক্ত জীবন নিয়ে মৃত্যুবরণ করার তাওফিক দান করুন। আমীন।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
📝 অনুগ্রহ করে ইসলামের মূল্যবোধ ও আখলাক বজায় রেখে শ্রদ্ধাশীল ও শালীন মন্তব্য করুন। আপনার বক্তব্যে সদয়তা ও নম্রতা রাখুন। সবাইকে সম্মান দিন। জাযাকাল্লাহ খাইর।