Translate

Native Banner

বৃহস্পতিবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

রুকইয়া করার সঠিক নিয়ম, উপকারিতা ও যে সূরা দিয়ে রুকইয়া করা হয়

রুকইয়াহ সুস্থতা 

 আধ্যাত্মিক  চিকিৎসা,

 কুরআন ও


 হাদীসের আলোকে



কুরআন ও হাদীসের আলোকে রোগমুক্তি, সুরক্ষা ও মানসিক শান্তির এক বিশুদ্ধ পদ্ধতি

ভূমিকা

ইসলামে রুকইয়াহ (আরবি: رقية) হলো একটি শরীয়তসম্মত ও পবিত্র চিকিৎসা পদ্ধতি, যা রোগ-ব্যাধি, শয়তানের কুমন্ত্রণা, জাদু, হিংসা, বা দুশ্চিন্তার মতো শারীরিক ও মানসিক সমস্যা থেকে আরোগ্য লাভের জন্য ব্যবহৃত হয়। এটি মূলত পবিত্র কুরআনের আয়াত, রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর শেখানো দোয়া এবং আল্লাহর স্মরণ দ্বারা পরিচালিত হয়। রুকইয়াহ শুধুমাত্র শারীরিক নিরাময়ের জন্যই নয়, বরং এটি আত্মিক পরিশুদ্ধি, মানসিক শান্তি এবং আল্লাহর প্রতি নির্ভরশীলতা বাড়ানোরও একটি কার্যকর উপায়। রাসূলুল্লাহ ﷺ নিজে রুকইয়াহ করেছেন এবং তাঁর সাহাবায়ে কেরামকেও এর অনুশীলন শিক্ষা দিয়েছেন, যা এর বৈধতা ও কার্যকারিতা প্রমাণ করে।

এই প্রবন্ধে আমরা রুকইয়াহ করার সঠিক পদ্ধতি, এর বহুমুখী উপকারিতা, কোন কোন সূরা ও দোয়া দিয়ে রুকইয়াহ করা হয় এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত ইসলামিক ও বৈজ্ঞানিক দিকগুলো নিয়ে একটি বিস্তারিত আলোচনা করব।


১. রুকইয়াহ করার সঠিক নিয়ম ও শর্তাবলী

রুকইয়াহ করার সময় কিছু মৌলিক শর্ত ও নিয়ম মেনে চলা আবশ্যক, যাতে এটি শরীয়তসম্মত হয় এবং এর পূর্ণ বরকত লাভ করা যায়। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:

"তোমাদের মধ্যে যার সাধ্য আছে, সে যেন তার ভাইকে উপকার করে (রুকইয়া দ্বারা)।" – (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ২১৯৯)

এই হাদীস থেকে বোঝা যায় যে রুকইয়াহ একটি উপকারী কাজ, তবে এর মূলনীতি হলো কুরআনুল কারীম ও সহিহ দোয়া দ্বারা আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করা, কোনো শিরক বা কুসংস্কারকে এর সঙ্গে যুক্ত করা যাবে না।

রুকইয়াহর ধাপসমূহ

  1. **বিশুদ্ধ নিয়ত (ইচ্ছা):** রুকইয়াহ শুরু করার আগে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি ও রোগমুক্তির জন্য বিশুদ্ধ নিয়ত করতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে যে এর সঙ্গে কোনো ধরনের শিরক বা অন্ধবিশ্বাস যেন মিশে না থাকে।
  2. **পূর্ণাঙ্গ তাওহিদ বিশ্বাস:** রুকইয়াহকারী এবং যার ওপর রুকইয়াহ করা হচ্ছে—উভয়েরই আল্লাহর একত্ববাদের ওপর পরিপূর্ণ বিশ্বাস থাকতে হবে। শিফা একমাত্র আল্লাহর হাতে, রুকইয়াহ কেবল একটি মাধ্যম।
  3. **পবিত্রতা:** রুকইয়াহ করার সময় পবিত্র অবস্থায় থাকা (অজু করে নেওয়া) উত্তম। এটি মনকে প্রশান্ত ও পবিত্র করে তোলে।
  4. **কুরআন তিলাওয়াত ও দোয়া:** রুকইয়াহর মূল অংশ হলো নির্দিষ্ট সূরা বা আয়াতসমূহ এবং সহিহ দোয়া পাঠ করা। এই পাঠ উচ্চস্বরে বা মৃদু স্বরে করা যেতে পারে।
  5. **ফুঁ দেয়ার নিয়ম:** আয়াত বা দোয়া পড়ার পর হালকা ফুঁ দেয়া সুন্নাহ। এই ফুঁ এমন হবে যেন বাতাস যায়, কিন্তু লালা না পড়ে। রুকইয়াহ করার সময় রোগীর শরীরের যে অংশে ব্যথা, সেখানে হাত রেখে বা সরাসরি ফুঁ দিয়ে পাঠ করা যায়।
  6. **রুকইয়াহর পানি ব্যবহার:** কিছু আলেম মনে করেন, কোরআনের আয়াত বা দোয়া পড়ে পানিতে ফুঁ দিয়ে সেই পানি রোগীকে পান করতে দেওয়া বা শরীরের আক্রান্ত অংশে ছিটিয়ে দেওয়া যায়। এটি রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সুন্নাহসম্মত।
  7. **নিজের জন্য রুকইয়াহ:** রুকইয়াহ করার জন্য অন্য কারো উপর নির্ভরশীল হওয়ার প্রয়োজন নেই। প্রত্যেক মুসলিম নিজেই নিজের জন্য রুকইয়াহ করতে পারে। রাসূলুল্লাহ ﷺ রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে সূরা ইখলাস, সূরা ফালাক ও সূরা নাস পড়ে হাত দিয়ে পুরো শরীর মাসেহ করতেন।

২. রুকইয়াহর বহুমুখী উপকারিতা

  • শারীরিক রোগ নিরাময়: রুকইয়াহ বিভিন্ন শারীরিক রোগ, যেমন—মাথাব্যথা, জ্বর, শারীরিক ব্যথা-বেদনা, দুর্বলতা এবং অন্যান্য অসুস্থতা নিরাময়ে কার্যকর। সহিহ হাদীসে রাসূল ﷺ নিজে এবং সাহাবায়ে কেরাম বিভিন্ন অসুস্থতার জন্য রুকইয়াহ করেছেন, যা এর কার্যকারিতা প্রমাণ করে।
  • মানসিক প্রশান্তি: রুকইয়াহ হতাশ, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, বিষণ্ণ ও উদ্বিগ্ন ব্যক্তিদের জন্য মানসিক শান্তি বয়ে আনে। আল্লাহর কালাম শোনার মাধ্যমে মন প্রশান্ত হয় এবং আল্লাহর উপর নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পায়।
  • জাদু, শয়তানের কুমন্ত্রণা ও হিংসা থেকে সুরক্ষা: রুকইয়াহ কালো জাদু, শয়তানের কু-প্রভাব, নজর লাগা এবং হিংসুকের ক্ষতি থেকে রক্ষা করে। এটি আত্মাকে শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে মুক্ত রাখে।
  • আত্মিক শক্তি বৃদ্ধি: রুকইয়াহ ঈমানকে মজবুত করে এবং আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল (নির্ভরতা) বৃদ্ধি করে। এটি ব্যক্তিকে আল্লাহর নৈকট্য লাভে সহায়তা করে।
  • পারিবারিক ও সামাজিক শান্তি: রোগ, অশান্তি ও জাদুর প্রভাব কমে গেলে পরিবার ও সমাজে শান্তি ফিরে আসে এবং পারস্পরিক বন্ধন শক্তিশালী হয়।

৩. যে সূরা ও দোয়া দিয়ে রুকইয়াহ করা হয়

রুকইয়াহর জন্য বিশেষ কিছু সূরা ও দোয়া ব্যবহার করা হয়, যা সরাসরি কুরআন ও হাদীসে উল্লেখিত।

কুরআনের আয়াতসমূহ

  • **সূরা ফাতিহা:** হাদিসে এসেছে, সাহাবায়ে কেরাম সাপের কামড়ে আক্রান্ত এক ব্যক্তির উপর সূরা ফাতিহা পড়ে চিকিৎসা করেছিলেন। এই সূরাটি 'শিফা' (আরোগ্য) হিসেবে পরিচিত।
  • **আয়াতুল কুরসী (সূরা বাকারা: ২৫৫):** এটি শয়তান এবং জাদু থেকে সুরক্ষার জন্য অত্যন্ত শক্তিশালী একটি আয়াত। রাতে ঘুমানোর আগে পাঠ করা সুন্নত।
  • **সূরা আল-বাকারা:** হাদিসে এসেছে, যে বাড়িতে এই সূরা পাঠ করা হয়, সেখান থেকে শয়তান পালিয়ে যায়। এটি ঘরের বরকত বৃদ্ধি করে।
  • **সূরা ইখলাস, সূরা ফালাক, সূরা নাস:** এই তিনটি সূরাকে 'মু'আউয়্যিযাত' বলা হয়। জাদু, নজর লাগা এবং শয়তানের ক্ষতি থেকে বাঁচার জন্য এই সূরাগুলো রাতে ঘুমানোর আগে পড়া উত্তম।
  • **সূরা তাওবা (১২৮-১২৯):** এই আয়াত দুটি বিপদাপদ থেকে মুক্তি ও মানসিক প্রশান্তির জন্য উপকারী।
  • **সূরা ইউনুস (৮১-৮২):** এটি জাদুর প্রতিকার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আল্লাহ বলেন, "তারা যে যাদু নিয়ে এসেছে, আল্লাহ তা বাতিল করে দেবেন।"
  • **সূরা ইসরা (৮২):** "আমরা কুরআন নাযিল করেছি, যা মু'মিনদের জন্য রহমত ও শিফা।"
  • **সূরা সফফাত (১-১০):** শয়তানদের থেকে হেফাজতের জন্য এটি পাঠ করা হয়।

রাসূল ﷺ এর দোয়াসমূহ

  • اللَّهُمَّ رَبَّ النَّاسِ، أَذْهِبِ الْبَأْسَ، اشْفِ، أَنْتَ الشَّافِي، لَا شِفَاءَ إِلَّا شِفَاؤُكَ، شِفَاءً لَا يُغَادِرُ سَقَمًا
    (হে আল্লাহ! মানুষের রব, রোগ দূর করে দাও। তুমি মহান চিকিৎসক, তোমার চিকিৎসা ছাড়া আর কোনো শিফা নেই। এমন শিফা দাও যাতে কোনো রোগ অবশিষ্ট না থাকে।)
  • أَعُوذُ بِكَلِمَاتِ اللَّهِ التَّامَّاتِ مِنْ شَرِّ مَا خَلَقَ
    (আল্লাহর পূর্ণাঙ্গ বাণীর সাহায্য চাই, তিনি যা সৃষ্টি করেছেন তার অকল্যাণ থেকে।)
  • بِسْمِ اللَّهِ أُرْقِيكَ، مِنْ كُلِّ شَيْءٍ يُؤْذِيكَ، مِنْ شَرِّ كُلِّ نَفْسٍ أَوْ عَيْنٍ حَاسِدٍ، اللَّهُ يَشْفِيكَ
    (আল্লাহর নামে তোমাকে রুকইয়াহ করছি। যা তোমাকে কষ্ট দিচ্ছে তা থেকে এবং প্রত্যেক দুষ্ট প্রাণী ও হিংসুক চোখ থেকে, আল্লাহ তোমাকে শিফা দিন।)

৪. রুকইয়াহর ইসলামী নির্দেশনা ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি

ইসলামী নির্দেশনা

  • রুকইয়াহ অবশ্যই কুরআন ও সহিহ হাদীসের আলোকে হতে হবে। এটি কোনো অন্ধবিশ্বাস নয়, বরং একটি ইবাদত।
  • এর সঙ্গে শিরক, তাবিজ, ঝাড়ফুঁক বা অজ্ঞাত শব্দ ব্যবহার করা সম্পূর্ণ হারাম।
  • রুকইয়াহর মাধ্যমে শিফা একমাত্র আল্লাহর কাছ থেকে আসে, কুরআন ও দোয়া শুধু মাধ্যম।

বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি

  • পজিটিভ সাইকোলজি: কুরআন তিলাওয়াত মানসিক চাপ, হতাশা ও উদ্বেগ কমিয়ে মানসিক প্রশান্তি এনে দেয়।
  • সাউন্ড থেরাপি: কুরআনের তিলাওয়াতের সুমধুর সুর এবং এর ছন্দবদ্ধতা শরীরের স্নায়ুতন্ত্রে এক ধরনের প্রশান্তির তরঙ্গ তৈরি করে।
  • স্ট্রেস রিলিফ: আল্লাহর জিকির এবং আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা ডিপ্রেশন ও মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে।
  • শারীরিক প্রতিক্রিয়া: কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, কুরআন শুনলে হৃদস্পন্দন নিয়মিত হয় এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে আসে।

উপসংহার

রুকইয়াহ হলো আল্লাহর নির্দেশিত এক মহৌষধ, যা আত্মিক, মানসিক ও শারীরিক সব দিক থেকে মানুষকে সুস্থ করে। এটি কোনো কুসংস্কার বা অন্ধবিশ্বাস নয়, বরং কুরআন ও হাদীস দ্বারা প্রমাণিত একটি চিকিৎসা ব্যবস্থা। তাই রোগ, দুশ্চিন্তা, জাদু কিংবা নজর লাগার সমস্যায় পড়লে একজন মুসলমানের উচিত রুকইয়াহর শরণাপন্ন হওয়া। মনে রাখতে হবে—শিফা একমাত্র আল্লাহর কাছ থেকে আসে, এবং আল্লাহর কালামের মাধ্যমে আমাদের জন্য আরোগ্য লাভ করা সহজ হয়।

© ২০২৫। সকল তথ্য কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে সংকলিত।

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

📝 অনুগ্রহ করে ইসলামের মূল্যবোধ ও আখলাক বজায় রেখে শ্রদ্ধাশীল ও শালীন মন্তব্য করুন। আপনার বক্তব্যে সদয়তা ও নম্রতা রাখুন। সবাইকে সম্মান দিন। জাযাকাল্লাহ খাইর।

অনুসরণকারী

DMCA.com

ব্লগ সংরক্ষাণাগার